।। বাক্‌ ১২৩ ।। এমাসের কবি ।।





বরিশালের গৈলা-ফুল্লশ্রী গ্রামের জ্যোৎস্নাকুমার দাশগুপ্ত আর যশোরের সান্ত্বনা দাশগুপ্তের প্রথম সন্তান কবি মৃদুল দাশগুপ্তের জন্ম 1955 সালের 3রা এপ্রিল হুগলী জেলার শ্রীরামপুরে..প্রথম বিদ্যালয়ের পাঠ পূর্ণচন্দ্র প্রাথমিকে,ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণী থেকেই দাপুটে, অতি চঞ্চল, দামাল ছেলেটির  ভালোবাসার সবটুকু অধিকার করে নিয়েছিল লেখালিখি, 1966 সালে প্রথম প্রকাশিত কবিতা "মোমবাতি", 1971 সালে ধূর্জটি চন্দ সম্পাদিত "এবং" ম্যাগাজিনে মৃদুলের সাতটি কবিতা ছাপা হয় যার থেকে কবিতা সিংহ তিনটি কবিতা নিয়ে 1973-74 প্রকাশ করেন তার সম্পাদিত সত্তরের দশকের কবিতার প্রথম সঙ্কলন "সপ্তদশ অশ্বারোহী" যার মধ্যে ছিলো সত্তর দশকের সতেরো জন নবীন কবির লেখা....উত্তরপাড়া রাজা প্যারিমোহন কলেজে কেমিস্ট্রি অনার্স নিয়ে ভর্তি হলেও 1975 এর মাঝামাঝি জুলোজিতে স্নাতক হন মৃদুল, 1976 সালে যোগ দেন জীবনের প্রথম চাকরিতে, শ্রীরামপুর ইউনিয়ন ইন্সটিটুইশনে বায়োলজির শিক্ষক হিসাবে যদিও কয়েক মাসের মধ্যে তা ছেড়েও দেন, এই বছরেই নবীন লেখক হিসাবে "ন্যাশনাল রাইটার্স এওয়ার্ড" পান তিনি, 1977 সালে প্রকাশিত হয় হাংরি জেনারেশন প্রভাবিত মৃদুলের বাল্য বয়সে গোপনে লেখা তিনটি গল্প নিয়ে প্রথম বই "আমি আর পিপি"(সংবর্ত প্রকাশনী)....1978 সালে সাংবাদিকতাকে পেশা করে যোগ দেন "পরিবর্তন"-এ,এখানে থাকাকালীন মৃদুল দাশগুপ্তের করা একটি কভার স্টোরির ভিত্তিতে মাঝ সমুদ্রে মারা যাওয়া ভারতীয় নাবিকদের পদমর্যাদা অনুযায়ী ভাসিয়ে দেওয়া অথবা পরিবারের কাছে মৃতদেহ পাঠানোর বৈষম্যমূলক ব্যাবস্থা পরিবর্তিত করে নতুন আইনের নির্মাণ হয়েছিলো, 1982 সালে তিনি যোগ দেন "যুগান্তর"-এ, 1985 তে বিবাহ মাধবী দাশগুপ্তকে, 1988 সালে জন্ম একমাত্র সন্তান মন্দাক্রান্তার.......1989 সালের 29-30 সেপ্টেম্বর কৃষ্ণনগরে, সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ,আসাম, অবিভক্ত বিহার ও বাংলাদেশের যে সমস্ত কবি সাহিত্যিক বাংলা ভাষায় ছোটো পত্র-পত্রিকায় লেখালিখি করেন,তাদের নিয়ে মৃদুল দাশগুপ্ত এক সমাবেশের আয়োজন করেন, তাঁরা একত্রে সাহিত্যের বাণিজ্যিকরণের বিরোধিতা করে বাণিজ্যিক কাগজের সঙ্গে কোনও সহযোগিতা না করার শপথ নেন,প্রকাশিত হয় "শত জলঝর্ণার ধ্বনি"-র প্রথম সঙ্কলন মৃদুল দাশগুপ্তের সম্পাদনায়,তিনি নিজে সেলিম পারভেজ ছদ্মনামে প্রচ্ছদ এঁকে দেন,"শত জলঝর্ণার ধ্বনি" হয়ে ওঠে এক আন্দোলনের নাম,এরপর কিছু বেকারত্বের দিন পেরিয়ে 1991 সালের 1লা জানুয়ারী থেকে "আজকাল"-এ শুরু হয় মৃদুলের কর্মজীবন.....
তার প্রকাশিত বইগুলি..."জলপাইকাঠের এসরাজ"(1980), "এভাবে কাঁদেনা"(1986), "গোপনে হিংসার কথা বলি"(1988), "এখন ঘটনাচক্রে"(1991), "ঝিকিমিকি ঝিরিঝিরি"(1997), "সূর্যাস্তে নির্মিত গৃহ"(1998), "আমপাতা জামপাতা"(1999), "একটি রূপকথা"(1999), "নির্বাচিত কবিতা"(1999), "প্রেমের কবিতা"(2001), "ছড়া পঞ্চাশ"(2001), "কবিতা সহায়"(2002), "ধানক্ষেত থেকে"(2007), "রঙিন ছড়া"(2008), "কবিতা সংগ্রহ"(2009), "সোনার বুদ্বুদ"(2010), "Selected Poems"(2010), "প্রিয় পঁচিশ"(2011)....

1975 এর ন্যাশনাল এওয়ার্ডের পর 1998 সালে "জলপাইকাঠের এসরাজ"-এর জন্যে "বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় স্মারক পুরস্কার" পান মৃদুল দাশগুপ্ত,2000 সালে "সূর্যাস্তে নির্মিত গৃহ"-এর জন্যে বাংলা একাডেমির "সুনীল বসু-অনিতা বসু পুরস্কার",2011 সালে ভারতচন্দ্রের জন্মস্থান পেরোগ্রামের "অভিষেক" পত্রিকার তরফ থেকে "ভারতচন্দ্র পুরস্কার",2012 সালে "সোনার বুদ্বুদ" কাব্যগ্রন্থের জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের "রবীন্দ্র পুরস্কার" সহ অজস্র সম্মানের প্রাপক কবি মৃদুল দাশগুপ্তের বিভিন্ন লেখা 2013 সাল থেকে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রাথমিক,মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বাংলা পাঠক্রমে গৃহীত হয়েছে..তিনি এখনও সৃষ্টিশীল,সূর্যোদয় সূর্যাস্তের মতোই কবিতা তার পৃথিবীর অলঙ্ঘনীয় সত্য,যাপনের নিয়মিত কৃত্য...

যদিও "ক্রন্দনরতা জননীর পাশে","দুর্ঘটনা","ক্লাউন","সমাধি ফলক" সহ মৃদুল দাশগুপ্তের অসংখ্য কবিতা ইতিহাসের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে কিন্তু এখানে তাঁর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে লেখা সিরিজ গুলি থেকে তিনটি সিরিজের অংশ ও "বাক"-এর জন্য নবনির্মানটিকে তুলে দেওয়া হলো....

                                                                     (সোনালী চক্রবর্তী)




[সিরিজ-এক]

এক 


সহজ হাওয়ার স্রোতে,তাদের কমলা গ্রীবা, কতিপয় সারসের পাশে
ধাতব ঝলক দিয়ে উড়ে যায় ভোরের বিমান
একটি নিমেষে রৌদ্র চুরমার খানখান মৃদু-মৃদু ত্রাসে
বাহুর বিস্তারে,বাক্যে, এরপর আমিও তো দ্রুত ধাবমান

কাকভোরে সরোবর, নেমে যাবে পাখিদের ঝাঁক
তত নয়,তাও বড়ো সহস্র বাতির ঘেরে হিথরো বন্দর
ধীরে সিন্ধু পার হব, অতি ঊর্ধে জ্বলজ্বল দেখাবে পোশাক
হিমেল বাতাসখানি অহেতুক মনে হবে ঝড় 




দুই 

জানেনা মাধবী কিছু, যখন একেলা আমি,মুণ্ডহীন ধড়
গৃহ শূন্য,অর্থাৎ উড্ডীয়মান ,তবে শীর্ষে ক-টি কবুতর
ভাবি তা আকাশফেরি নীলনভে অতিকায় উড়ন্ত শহর
চাঁদ সূর্য একযোগে ঢুকে পড়ে ঘরের ভিতর

কত না দুর্যোগ ঘটে এর ফলে, হয়ে যায় দিন রাত্রি রদ
ওড়ে গ্রন্থ,কাঠ-খড়, ঢেউ টিন,পোপের সনদ
চন্দ্র সুভদ্র অতি, তবে সূর্য অতিশয় বদ
খ্যা-খ্যা করে হাসে আর খালিগায়ে ঢেলে দেয় মদ




তিন 

আমি ও কবিতাখানি মুখোমুখি বসে আছি,আমাদের উভয়ের কথোপকথনে 
ভাবে রাত্রি, থাকি থাকি; মদিরার ঢেউ দেয় বঙ্গোপসাগর
থামে চন্দ্র, তারাদল, নাটকীয় কত কিছু ঘটে যায় গগনে-গগনে
আবছা বাতাস এসে আমাদের টেনে নেয়, বিনা ঝড়ে ওড়ে এই ঘর 

সেগুন মঞ্জরী ঝরে গোপন কাঠের ভীরু মোহময় আবরণ থেকে
উল্কার আলো লেগে সচকিত লোহা যেন জ্বলে
শীতের কুয়াশা দেয় আমাদের ধীরে-ধীরে নীল রঙে ঢেকে

এ কবিতা মৃদুলের,প্রভাতে গুঞ্জনরত শিশুগণ বলে




চার 


আঙুলের মৃদু স্পর্শে আমার দোতারাখানি অতি ঊর্ধে বাজে
কখনো কাতরভাবে, ফুর্তিতে আবার যেন টিঙি টিঙি গুব গুব
এ ভূমি কম্পিত হয়,তোমারও কি নিদ্রা যায় আওয়াজে-আওয়াজে?
এক চন্দ্র যথাস্থানে, আর চন্দ্র জলে দেয় ডুব


কেননা ক্রন্দনরত বাতাসের মাঝে ঢুকে সে সুর বেরিয়ে আসে পুনরায় খ্যাপার উল্লাসে
তোমাকে খোঁজে না আর, নেচে-নেচে মনে করে ফের ভুলে যায়
অতলের তলে ডুবে চুপচাপ বসে থাকে,ফস করে ওঠে ঊর্ধ্বাকাশে
দাপাদাপি দেখে ফোটে এমন নিশুতকালে বেগনি-বেগনি ফুল পুঁইয়ের মাচায়





[সিরিজ-দুই] 


এক   


আড়ালে তারকাপুঞ্জ হাসে তাও আমার মোচার খোলা ভাসে
যখন শনির আলো অতিক্ষীণ পড়ে বাঁশঝাড়ে
গ্রহাণু এড়িয়ে যাই ছায়াপথ ছেড়ে দিয়ে ঈষৎ বাঁ-পাশে
ফলে তো পশ্চাতে ফিরি দশ, নয়,বারো থেকে দু-হাজার চারে


এবার বাতাস যেন অতিবাম কেন্দ্রীয় কমিটি,ক্ষোভে বলে,বিচ্যুত-বিচ্যুত
হুলিয়া,শিকল নিয়ে এরপর ঘিরে ধরে অং বং চং মং গ্রহ
তিমির গহ্বরে পড়ে ডিঙিখানি পুড়ে যায়,আমিও তো অতি ভস্মীভূত
ঊর্দ্ধলোকে দাউ-দাউ ওই জ্বলে কবিতা সংগ্রহ


দুই 


আর তত উঁচু নয়, তবু তার ছায়াখানি তা প্রায় বাতাস
নীরব মসৃন বেলা, এলোমেলো ঢেউ আর চারপাশে নত
এ বনের গাছগুলি, বুকউঁচু অন্তহীন ঘাস
সেসব পেরিয়ে গেলে জলাশয়, বাঘিনী শাবকসহ জলপানরত

এ সকল গ্রন্থের মলাট
পাথরে হেলান দিয়ে পাঠ করে ওই সে বিরাট



তিন 

আমি আবছায়া আঁকি, তুমি তাতে স্পষ্ট করে লেখো নিজনাম
ফলে মৎস্য খাবি খায়, দপদপ করে পুস্করিণী-
এই চিত্র নিজে হাঁটে, পার হয় দুইশত তিনশত গ্রাম
কালের কেতাব হয়ে যখন নগরে ঢোকে,লোকে ভাবে
এ তবে কাহিনী

আমরা উভয়েই তাই কিছু সরে থাকি,বনতরুতলে
এ বাদে নিশুতে আর কিবা কাজ তামাম বাংলায়
খেজুরের রাঙা ফল টুপ টুপ ঝরে পড়ে অন্ধকার জলে
নদে ভেসে যায়.......



[সিরিজ-তিন]


এক


যেন না গড়িয়ে পড়ি, আমাকে জড়িয়ে ধরে
পানীয় সকল
চোখে ঠুলি এঁটে দেয় চাঁদ সূর্য একত্রে দুজন
জানলার ফাঁক দিয়ে ধেয়ে এসে হাওয়া নেয়
আমার দখল
কানে তুলো আঁটে মেঘ,যেন না কখনো শুনি
পাখির কূজন

এক পা দুই পা করে দুপদুপ এগোয় দেয়াল
চাবিটি স্বয়ং উড়ে নাসারন্ধ্রে দিয়ে দেয় তালা
সিমেন্ট সুড়কি বালি ইঁট কাঠ লোহা আঠা গালা
আমাকে জাপটে করে হুটোপুটি-তাদের খেয়াল

যত বলি আমি ধীর, সদাশয়, নিপাট নিরীহ
চকিতে পালাই যদি, ঝুড়ি চাপা দিয়ে দেয় গৃহ



দুই 


'তুমি চন্দ্রে হাত দিয়েছিলে!গহ্বরে আঙুল দিয়ে
পেয়েছিলে মধু!
চেটেছিলে চাঁদের বরফ?গড়ালে চাঁদের গায়ে,চাঁদে?
চাঁদ কী বলল, শুনি'-কন্যা জিজ্ঞাসা করে,
'বলো বলো'-হেসে বলে বধূ
চুরুট ধরিয়ে আমি ধীরে ধীরে উঠে যাই ছাদে


'এই তো চাঁদের লোক'-অযুত তারকারাশি একযোগে বলে
'ওর গায়ে বালি লেগে, তা চাঁদের ওপিঠের বালি!'
'ও চাঁদের', 'ও চাঁদের'-চারিদিকে ঘন ঘন তালি
আমি উড়ে চলে যাই পুনরায় চাঁদের দখলে




("বাক"-এর জন্য)



একটি পাতা

কী ঘুম ঘুমিয়ে পড়ি, হাসে ইতিহাস
থামে সে গাড়ির চাকা,
লোকালয় হয় ফাঁকা,
ছিলো তো একটি চাঁদ, হয়ে গেলো সাতাশ-আঠাশ


আকাশও তো একা নয়,তদুপরি কয়েক আকাশ
সভয়ে একের পরে
টাল খায়,ভেঙে পড়ে,
সহসা সহস্র পাখি আঁচড়ায় হাজার বাতাস 


তখন নিদ্রার ঘোরে
আমারও তো দেহ ওড়ে
তবে কিনা পাশ ফিরি, বুক ভরে নিতে চাই শ্বাস




                                      [তথ্য ঋণ, "বোধ শব্দ পত্রিকা" এবং অভিমন্যু মাহাতো]


4 comments:

  1. আবৃত্তির ভঙ্গি।
    পরতে গিয়ে ধারা এমনই ধীর আর স্হীর হয়ে যাচ্ছে যেন

    ReplyDelete
  2. ভাসমান ভাব ভাবনার সুন্দর কবিতা লেগেছে--

    ReplyDelete